স্বদেশ ডেস্ক:
ব্যাংকের মুনাফা বণ্টনের কঠোর নীতি থেকে সরে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শিথিল হচ্ছে ব্যাংকের মুনাফা বণ্টন নীতিমালা। স্থানীয় হোক বা বিদেশী হোক ব্যক্তিশ্রেণী হলেই নগদে লভ্যাংশ পাবেন ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরা। আজ বুধবার এ বিষয়ে একটি সার্কুলার জারি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যাদের কারণে ব্যাংকগুলোর আজ এ করুণ পরিণতি, ওই সব রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। আর তাদের পাপের পরিণতি ভোগ করছেন সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা। বছর শেষে লভ্যাংশ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। অথচ রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় আনা হলে ব্যাংকের চেহারাই পরিবর্তন হয়ে যেত। অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখতে পারত দেশের ব্যাংকিং খাত।
জানা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর প্রায় ৩৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে ব্যক্তিশ্রেণী বিনিয়োগকারীদের হাতে। বাকি প্রায় ৬৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে ব্যাংকের উদ্যোক্তা ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে। মুষ্টিমেয় কিছু ঋণগ্রহীতা ব্যাংকগুলো থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দিচ্ছেন না। নামে- বেনামে ঋণ নিচ্ছেন ব্যাংকের উদ্যোক্তারা। ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। বড় অঙ্কের ঋণ এসব অসাধু ঋণগ্রহীতার কাছে আটকে যাওয়ায় ব্যাংকগুলো ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। অনেকটা নয়-ছয় করে কিছু কিছু ব্যাংক মূলধন ঘাটতি সমন্বয় করছে। আবার ঋণের নিরাপত্তার জন্য খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে। কিন্তু বড় অঙ্কের ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকগুলোর প্রকৃত মুনাফাও কমে গেছে। এতে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছে না অনেক ব্যাংক। প্রভিশন সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও অনেক সময় জোড়াতালি দেয়া হচ্ছে। বাকিতে প্রভিশন সংরক্ষণের অনুমোদন দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ব্যাংকের প্রকৃত মূলধন কমে যাচ্ছে।
ব্যাংকগুলোর মূলধনের ভিত্তি শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ ব্যাংক তাই শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে নগদে লভ্যাংশ বণ্টনের ক্ষেত্রে সম্প্রতি বিধিনিষেধ আরোপ করে। বলা হয়, ব্যাংকগুলো ইচ্ছে করলেই লভ্যাংশ বণ্টন করতে পারবে না। এ জন্য ন্যূনতম মূলধনের ভিত্তি বেঁধে দেয়া হয়। যেসব ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের হার ১০ শতাংশের কম রয়েছে ওই সব ব্যাংক কোনো লভ্যাংশ বণ্টন করতে পারবে না। আর যারা ইতোমধ্যে বাকিতে খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করছে তারা ৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মুনাফা বিতরণ করতে পারবে। তবে সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। আর যারা বাকিতে প্রভিশন সংরক্ষণ করেনি, মূলধন সংরক্ষণের সক্ষমতা অনুযায়ী তারা সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশ বিতরণ করতে পারবে। তবে সেপ্টেম্বরের আগে নগদে লভ্যাংশ বণ্টন করা যাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের সাথে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নয়া চেয়ারম্যান বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে পুঁজিবাজারে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে লভ্যাংশ দেয়ার নীতিমালা কিছুটা শিথিলের অনুরোধ জানান। তার অনুরোধের কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
গতকাল এ নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করেন বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা। বৈঠকে ব্যক্তিশ্রেণীর কী পরিমাণ শেয়ারহোল্ডার ব্যাংকিং খাতে রয়েছে, নগদে লভ্যাংশ দেয়ার অনুমোদন দেয়া হলে কী পরিমাণ অর্থ বের হয়ে যাবে সেসব নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আন্তঃবিভাগীয় একাধিক বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে দেশী-বিদেশী ব্যক্তিশ্রেণীর শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে নগদ লভ্যাংশ বণ্টনের অনুমোদনের বিষয়ে একমত পোষণ করা হয়েছে।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ রয়েছেন ব্যক্তিশ্রেণীর বিনিয়োগকারী। তাদের মধ্যে দেশী ও বিদেশী দুই ধরনের বিনিয়োগকারীই রয়েছেন। যেহেতু করোনাভাইরাসের কারণে এখন ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে; অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন, কারো বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে গেছে, এমনি পরিস্থিতিতে ব্যক্তিশ্রেণীর শেয়ারহোল্ডারদের নগদে লভ্যাংশ দেয়ার অনুমোদন দেয়া হলে তারা উপকৃত হবেন। এ কারণেই আগের নির্দেশনা শিথিল করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আজ ব্যাংকগুলোর জন্য সার্কুলার জারি করা হবে।
তবে, সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পাপ করে একজন, দায় চাপে আরেক জনের ওপর। ব্যাংকগুলোর শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষেত্রেও ওই একই অবস্থা হয়েছে। রাঘববোয়ালরা ঋণ নিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। তাদের কারণে ব্যাংকগুলো এখন ডুবতে বসেছে। এসব রাঘববোয়ালকে আইনের আওতায় আনা হলে ব্যাংকগুলোর আজ এ করুণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতো না। রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের দায় চাপছে আজ ব্যাংকের সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কাঁধে। আর বছর শেষে লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এসব সাধারণ শেয়ারহোল্ডার।